ছেলের খৎনার সময়, যা বেশিরভাগ মুসলিম পরিবারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রথা,এটি শুধু সাংস্কৃতিক নয়, স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। তবে, খৎনা করার আদর্শ সময় নিয়ে বহু অভিভাবকের মধ্যে প্রশ্ন থেকে যায়। কখন খৎনা করা উচিত? কোন বয়সে খৎনা করানো নিরাপদ এবং উপকারী হবে? এই লেখায়, আমরা খৎনা করার আদর্শ সময়, বয়স অনুযায়ী এর সুবিধা এবং ঝুঁকি এবং চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
কোন বয়সে খৎনা করানো উত্তম?
ছেলের খৎনা সময় নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতির ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। যদিও যেকোনো বয়সেই খৎনা করা সম্ভব, তবে কিছু নির্দিষ্ট সময় রয়েছে যা শারীরিক ও মানসিকভাবে সবচেয়ে উপযুক্ত।
বয়সভেদে শারীরিক প্রস্তুতি
নবজাতক বয়সে খৎনা করা অনেকাংশেই সহজ হতে পারে, কারণ শিশুদের ত্বক অনেক নরম এবং কম ইনফেকশনের ঝুঁকি থাকে। তবে, নবজাতক বয়সে কিছু সমস্যা হতে পারে যেমন—প্যানিসের মাথায় অতিরিক্ত চামড়া আটকে থাকার কারণে ঘা শুকানোর সময় বেশি লাগে। এ কারণে, ৪-৬ বছর বয়সে খৎনা করানো সবচেয়ে নিরাপদ এবং কার্যকর।
এই বয়সে শিশুদের প্যানিসের মাথা (গ্ল্যান্স) সঠিকভাবে তৈরি হতে শুরু করে এবং খৎনা করার পর শুকানোর প্রক্রিয়া দ্রুত হয়। ৪-৬ বছর বয়সে, শিশুর শারীরিক গঠন অনেকটা পরিপক্ব হয়ে ওঠে, ফলে খৎনা পরবর্তী সুস্থতা বেশ দ্রুত হয় এবং ইনফেকশনের ঝুঁকি কমে যায়।
মানসিক পরিপক্বতা বিবেচনা
শিশুর মানসিক পরিপক্বতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৪-৬ বছর বয়সের শিশুদের মানসিক অবস্থা খৎনা করার জন্য উপযুক্ত। এই বয়সে তাদের বোঝার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা খৎনা করার প্রক্রিয়াটি সহজভাবে মেনে নিতে পারে। তাছাড়া, এই বয়সের শিশুর স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা হয় না, ফলে তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপে তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয় না।
বয়স অনুযায়ী খৎনার ঝুঁকি ও সুবিধা
বয়সের সাথে সাথে খৎনার সুবিধা এবং ঝুঁকি পরিবর্তিত হয়। শিশুর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে খৎনার শারীরিক প্রভাব এবং সেরে ওঠার সময়ও ভিন্ন হয়।
নবজাতক বনাম বালক
নবজাতক বয়সে খৎনা করানোর সুবিধা হলো—তাদের শরীরের ত্বক অনেক নরম এবং তারা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে, বালক বয়সে খৎনা করলে ব্যথা বেশি হতে পারে এবং সুস্থ হতে সময়ও বেশি লাগে। তাছাড়া, বালক বয়সে শিশুর মানসিক প্রস্তুতি সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত থাকে, যা তাদের খৎনা প্রক্রিয়াকে আরও সঠিকভাবে গ্রহণ করতে সহায়তা করে।
ব্যথা ও সংক্রমণ তুলনা
নবজাতক বয়সে খৎনা করলে ব্যথা কম হয় এবং ইনফেকশনের ঝুঁকি কম থাকে। তবে, বড় বয়সে খৎনা করলে ব্যথা কিছুটা বেশি অনুভূত হয় এবং সেরে ওঠার জন্য কিছুটা বেশি সময় লাগতে পারে। তাছাড়া, বড় বয়সে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকাংশে শক্তিশালী থাকে, যা সুস্থতার জন্য সহায়ক।
চিকিৎসকের মতে সঠিক সময় বাছাই
বাচ্চাকে কখন খৎনা করানোর উচিত প্রসঙ্গে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হসপিটালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা.এহসানুল কবির স্যার বলেন, “আসলে খৎনা একটা মেডিকেল সাইন্সের একটা বিশাল একটা দিক, এটার কিন্তু আসলে সাইনটিফিক বেনেফিট রয়েছে এবং আমরা সচারাচর বলি যে, বাচ্চার যখন ৬ বছর বয়স হবে তখন থেকেই খৎনা দেওয়া শুরু করবেন। কেন বলি এটা কারণ খতনা দেওয়ার সময় বাচ্চারা অনেক সময় ভয় পায় তারপরে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে এবং যিনি খতনা করাবেন তার কিন্তু অসুবিধা হয় করাতে এবং বাচ্চাকে বোঝানো যায় না এবং ৬ বছর বয়সে বাচ্চাকে বুঝিয়ে পরিয়ে রাখা যায় এবং সে ঠান্ডা থাকে এবং খতনাটা করতে সুবিধা হয়।এ কারণে খতনা দেওয়া যেতে পারে এই বয়স থেকে।
তিনি আরও বলেন, তবে যেকোনো বয়সে কিন্তু খতনা দেওয়া যায় এমনকি নবজাতক বাচ্চার প্রথম দিন থেকেই কিন্তু খতনা দেওয়া যেতে পারে বিভিন্ন কারণে। তাছাড়া অনেক সময় বাচ্চাদের পুরুষাঙ্গের মাথা স্কিনে ফুলে যায়,লাল হয়ে যায়, অনেক সময় ময়লা সাদা সাদা ময়লা বের হয় সেগুলোর কারণে কিন্তু খতনা দেওয়া লাগতে পারে। সেগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে সচারাচর স্বাভাবিক যে খতনাটা সেটা ৬ বছর বয়স থেকে দিতে হবে এবং এর সাথে সাধারণত যে গ্রাজুয়েট এম.বি.বিএস ডক্টর যারা তাদের দ্বারা দেওয়াটা ব্যাটার। আর যদি খুব ছোট বাচ্চা হয় তাহলে সার্জারী বিশেষজ্ঞ যারা শিশু সার্জারী বিশেষজ্ঞ তাদের মাধ্যমে দিতে পারলে আরও ভালো হয়। তাই এই দিকটা আপনারা খেয়াল রাখবেন।”
আলিসক্ল্যাম্প ও বয়সভেদে উপযোগিতা
আলিসক্ল্যাম্প পদ্ধতি বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়, কারণ এটি দ্রুত এবং কার্যকর খৎনা করার পদ্ধতি। বিশেষ করে ছোট শিশুদের জন্য এটি বেশ উপযোগী।
ছোট শিশুদের জন্য উপযুক্ত
আলিসক্ল্যাম্প পদ্ধতি ছোট শিশুদের জন্য খুবই উপযোগী কারণ এটি অত্যন্ত দ্রুত এবং ব্যথাহীন পদ্ধতিতে খৎনা সম্পন্ন করে। ছোট বয়সে এটি ইনফেকশনের ঝুঁকি কমায় এবং সুস্থ হতে সহায়তা করে।
উচ্চবয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে কীভাবে কার্যকর
উচ্চবয়সী শিশুদের জন্যও আলিসক্ল্যাম্প কার্যকর, তবে ব্যথা কিছুটা বেশি হতে পারে। উচ্চবয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এটি করা উচিত এবং তাদের মানসিক প্রস্তুতিও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
পিতামাতার দায়িত্ব ও সিদ্ধান্ত নেওয়া
খৎনা করা একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। পিতামাতার উচিত সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সন্তানের জন্য উপযুক্ত সময় বাছাই করা।
সংবেদনশীলতা ও কাউন্সেলিং
ছেলের খৎনার সময় করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাবা-মায়েদের অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক প্রস্তুতির বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন হওয়া জরুরি। তাছাড়া, খৎনা পরবর্তী যত্ন এবং মনস্তাত্ত্বিক সহায়তাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবারভিত্তিক আলোচনা
খৎনা একটি পারিবারিক সিদ্ধান্ত, তাই এটি নিয়ে বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে আলোচনা হওয়া উচিত। এই আলোচনা সন্তানের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার প্রতি নজর দেওয়ার একটি ভালো মাধ্যম।
উপসংহার
ছেলের খৎনা সময় নির্বাচন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা অনেকগুলি শারীরিক এবং মানসিক উপাদানের উপর নির্ভরশীল। ৪-৬ বছর বয়সে খৎনা করানো সবচেয়ে নিরাপদ এবং কার্যকর, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে যেকোনো বয়সে এটি করা সম্ভব। পিতামাতার উচিত এই সিদ্ধান্তটি মনোযোগ সহকারে এবং সন্তানের সুস্থতার দিক বিবেচনা করে নেওয়া।