কীভাবে খৎনা করা হয়? খৎনা (Circumcision) হলো একটি চিকিৎসা ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া, যেখানে পুরুষ শিশুর অগ্রচর্ম (foreskin) অপসারণ করা হয়। মুসলিম সমাজে এটি সুন্নাহ হলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানে রয়েছে এর বহুমুখী উপকারিতা। শিশুদের স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা ও ভবিষ্যৎ রোগ প্রতিরোধের জন্য খৎনা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
কিন্তু অনেক অভিভাবকের মনে প্রশ্ন থাকে: খৎনা কীভাবে করা হয়? কোন পদ্ধতি ভালো? শিশুর মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত? আর খৎনার পর কীভাবে যত্ন নিতে হয়?
আজকের এই ব্লগে আমরা ধাপে ধাপে পুরো প্রক্রিয়াটি আলোচনা করব।
প্রস্তুতির ধাপ
খৎনা করার আগে কিছু বিষয় জানা ও মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।
শিশুর মানসিক প্রস্তুতি
- ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে: তারা সাধারণত প্রক্রিয়া বুঝে না তাই খেলাধুলা, স্নেহ ও আরামদায়ক পরিবেশের মাধ্যমে মানসিক স্বস্তি দেওয়া দরকার।
- বড় শিশুদের ক্ষেত্রে: তাদেরকে সহজভাবে বুঝিয়ে বলা উচিত যে এটি একটি স্বাভাবিক চিকিৎসা প্রক্রিয়া। ভয় না পেয়ে সাহস রাখলে দ্রুত আরোগ্য হবে এমন বার্তা দেওয়া দরকার।
অভিভাবকদের শান্ত ও আত্মবিশ্বাসী আচরণ শিশুর মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
স্বাস্থ্য চেকআপ
খৎনার আগে চিকিৎসক সাধারণত শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন:
- শিশুর রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা আছে কিনা তা দেখা হয়।
- ত্বকে কোনো ইনফেকশন বা অ্যালার্জি থাকলে আগে চিকিৎসা করা হয়।
- শিশুর বয়স ও ওজন অনুযায়ী কোন পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো হবে তা নির্ধারণ করা হয়।
কীভাবে খৎনা করা হয়? প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে
খৎনার ধাপগুলো ব্যবহৃত পদ্ধতির উপর নির্ভর করে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, তবে মৌলিক কাঠামো একই।
অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ
- খৎনার আগে স্থানীয় অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয় (ইনজেকশন বা জেল আকারে)।
- ছোট শিশুদের জন্য সাধারণত হালকা ওষুধ ব্যবহার করা হয় যাতে তারা ব্যথা অনুভব না করে।
- কখনও কখনও নবজাতকের ক্ষেত্রে বিশেষ পেইন-রিলিফ টেকনিক ব্যবহার করা হয়।
কাটিং ও সেলাই
- সার্জিকাল খৎনায় স্ক্যালপেল বা কাঁচি দিয়ে অগ্রচর্ম কেটে ফেলা হয়।
- এরপর রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ করে সেলাই দেওয়া হয়।
- রিং বা আলিসক্ল্যাম্প ব্যবহারে সাধারণত সেলাইয়ের দরকার হয় না।
- পুরো প্রক্রিয়া ১৫-৩০ মিনিটে শেষ হয়।
ব্যবহৃত পদ্ধতির তালিকা
বর্তমানে খৎনার জন্য চারটি প্রধান পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।
রিং, সার্জিকাল, লেজার, আলিসক্ল্যাম্প
১) রিং খৎনা (Plastibell Circumcision):
- একটি প্লাস্টিক রিং অগ্রচর্মের নিচে বসানো হয়।
- রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে অগ্রচর্ম শুকিয়ে যায়।
- ৭-১০ দিনের মধ্যে রিং নিজে থেকেই পড়ে যায়।
- নবজাতক ও ছোট শিশুদের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয়।
২) সার্জিকাল খৎনা:
- স্ক্যালপেল বা কাঁচি দিয়ে অগ্রচর্ম কেটে সেলাই দেওয়া হয়।
- প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর।
- আরোগ্যের সময় তুলনামূলক বেশি লাগে।
৩) লেজার খৎনা:
- আধুনিক প্রযুক্তি, যেখানে লেজার দিয়ে অগ্রচর্ম কাটা হয়।
- রক্তপাত প্রায় নেই বললেই চলে।
- আরোগ্য দ্রুত হয়।
- তবে সব জায়গায় এই পদ্ধতি সহজলভ্য নয়।
৪) আলিসক্ল্যাম্প (Alisklamp):
- WHO, FDA এবং ISO দ্বারা অনুমোদিত একটি আধুনিক পদ্ধতি।
- রক্তপাত ও ব্যথা খুবই কম হয়।
- শিশু ও কিশোরদের জন্য উপযোগী।
উপকারিতা ও পার্থক্য
- রিং ও আলিসক্ল্যাম্প শিশুদের জন্য দ্রুত ও নিরাপদ।
- সার্জিকাল খৎনা সব বয়সের জন্য উপযোগী, তবে সুস্থ হতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগে।
- লেজার খৎনা আধুনিক হলেও খরচ বেশি এবং সব ক্লিনিকে পাওয়া যায় না।
পরিচর্যার নিয়মাবলি
খৎনার পর সঠিক যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঔষধ প্রয়োগ
- চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক ও অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম ব্যবহার করতে হয়।
- শিশুকে যথেষ্ট পরিমাণে পানি পান করাতে হবে।
পরবর্তী পর্যবেক্ষণ
- প্রতিদিন ক্ষতস্থান পর্যবেক্ষণ করুন।
- ড্রেসিং সবসময় পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে।
- নবজাতকের ক্ষেত্রে ডায়াপার ঘন ঘন পরিবর্তন করা উচিত।
- কোনো রকম অতিরিক্ত রক্তপাত, দুর্গন্ধ বা জ্বর হলে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।
চিকিৎসকের পরামর্শ
সমস্যা হলে কবে যাবেন
- যদি রিং বা ক্ল্যাম্প ১০-১২ দিনের মধ্যে না পড়ে।
- অতিরিক্ত রক্তপাত বা ফোলাভাব দেখা দেয়।
- শিশুর জ্বর, অস্বাভাবিক ব্যথা বা পুঁজ হয়।
ফলোআপের সময়সূচি
- সাধারণত খৎনার ২-৩ দিন পর প্রথম চেকআপ হয়।
- এরপর ৭-১০ দিনের মধ্যে দ্বিতীয়বার চেকআপ করা হয়।
- প্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদি ফলোআপও করা হয়।
খৎনা একটি নিরাপদ ও প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে এর সাফল্য নির্ভর করে শিশুর প্রস্তুতি, সঠিক পদ্ধতি বেছে নেওয়া, জীবাণুমুক্ত পরিবেশ এবং পরবর্তী পরিচর্যার উপর।
পিতামাতার উচিত:
- শিশুকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা
- অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে খৎনা করা
- খৎনার পর নিয়মিত পরিচর্যা ও ফলোআপ বজায় রাখা
সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে খৎনা হবে নিরাপদ, ব্যথামুক্ত এবং শিশুর জন্য স্বাস্থ্যকর অভিজ্ঞতা।