সুন্নতে খৎনা কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
পুরুষাঙ্গের সামনের বা মাথার দিকে যে অতিরিক্ত চামড়া পুরুষাঙ্গের সংবেদনশীল মাথাকে ঢেকে রাখে, তা কেটে বাদ দেওয়াকেই খতনা বা মুসলমানি বলা হয়। মেডিক্যাল টার্মে একে বলে সারকামসিশন। সারকামসিশন শব্দটি এসেছে লাতিন সারকামডায়ার থেকে, যার অর্থ হলো চারদিক থেকে কেটে ফেলা। মুসলিম জাতি ছাড়াও অন্য ধর্মাবলম্বীরাও খতনা দিয়ে থাকে।
ইসলামী ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে এটি সুন্নাহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ফিতরাত অর্থাৎ নবীদের সুন্নত পাঁচটি। তা হলো, খৎনা করা, নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করা, বগলের লোম উপড়ে ফেলা, নখ কাটা এবং গোঁফ খাটো করা। -(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৮৮৯)
সর্বপ্রথম এ সুন্নত পালন করেছেন হজরত ইবরাহিম (আ.)।ইবরাহিম (আ.)-এর পর সব নবী-রাসুলই খাতনা করিয়েছিলেন। অনেক হাদিসে এ সুন্নত পালনের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
হজরত সাইদ ইবনে মুসাইয়াব (রহ.) থেকে বর্ণিত, হজরত ইবরাহিম (আ.) হলেন খতনার সুন্নত পালনকারী সর্বপ্রথম ব্যক্তি। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ২৬৪৬৭)
কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম (আ.)-কে তাঁর রব কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করেন। তিনি বলেন, আমি তোমাকে মানুষের জন্য নেতা বানাব। সে বলল, আমার বংশধরদের থেকেও? তিনি বলেন, জালিমরা আমার ওয়াদাপ্রাপ্ত হয় না। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১২৪)
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা পুরুষের খতনাকে আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত বলে মনে করেন। খতনার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকজাতীয় (ব্যাকটেরিয়া) রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। খতনার প্রধান সুবিধা হলো, এর ফলে লিঙ্গের অগ্র ত্বকে যে তরল জমে নোংরা অবস্থার সৃষ্টি করে, তা থেকে রেহাই পেতে পারে। দেড় হাজার বছর আগে মহানবী (সা.) খতনার কথা বলেছেন, ব্যাপক গবেষণা শেষে আজকের আধুনিক বিজ্ঞান স্বীকার করেছে, খতনার ব্যাপক উপকারিতা আছে।
খতনার সুফল নিয়ে অস্ট্রেলীয় মেডিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. ব্রায়ান মরিস গবেষণা করেছেন। তার সেই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, যেসব বালকের সারকামসিশন (খতনা) করা হয়নি, তাদের অপেক্ষাকৃত কিডনি, মূত্রথলি ও মূত্রনালির ইনফেকশন চার থেকে ১০ গুণ বেশি হয়। তিনি মনে করেন, সারকামসিশনের (খতনা) মাধ্যমে অন্তত এক-চতুর্থাংশ মূত্রনালির ইনফেকশন হ্রাস করা যায়।
অন্যদিকে ওয়াশিংটনের সৈনিক মেডিক্যাল কলেজের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. বিজবেল সুন্নতে খৎনা নিয়ে বলেন, প্রথম দিকে আমি খতনার বিরোধী ছিলাম, পরে দীর্ঘ গবেষণার ফলে প্রমাণিত হলো যে মূত্রথলি ও মূত্রনালিবিষয়ক অনেক জটিল রোগের সমাধান হলো খতনা। তাই আমি বলতে পারি খতনা একটি বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি।
সুন্নতে খৎনা-এর জন্য উপযুক্ত সময় এবং বয়স
খৎনা করার আদর্শ বয়স সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু সার্জারী বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ মোঃ হামিদুর রহমান স্যার বলেন, “বিদেশ থেকে একটা পারসেপশন আমাদের দেশে এসেছে যে হসপিটালে ডেলিভারি করার পরপর যদি মুসলমানি করে দেওয়া যায় তাহলে বাচ্চা মেবি ব্যাথা পায়না। এটা একটা ধারণা আছে। আসলে ওয়েস্টার্ন কানট্রিতে এরকম একটা ট্রেন্ড শুরু হয়েছিল, পরে দেখা গেছে আর্লি সারকামসিশন বা খৎনা করলে কিছু কিছু সমস্যা দেখা দেয়। এজন্য ট্রেন্ড থেকে একটু দূরে সরে আসছে। তবুও কিছু কিছু কাস্টের মধ্যে এ প্রথাটা রয়েছে। তবে আইডিয়াল এজ বলে একটা কথা আছে সেটা হচ্ছে ৪-৬ বছর।
এই বিষয়ে তিনি আরও বলেন, এ সময় প্যানিসের মাথায় যে বাড়তি চামড়াটা থাকে সেটা গ্ল্যান্স বলি আমরা মাথা যেটা ওর সাথে এঢারেন্ট হয়ে থাকলে ঘা শুকাতে একটু দেরি হয়। ৪-৫ বছরের সময় ঐটা ল্যুজ হয়ে যায়, ঐ বছরের বাচ্চাকে কিন্তু ম্যানেজও করা যায়, এটা যদি অ্যানেসথেসিয়া দিয়েও করেন তাও সেইফ অনেকখানি কারণ তাদের বয়সটা একটু বড় হইছে, কথা বললেও শুনে বা স্কুলিং এর ব্যাপারটা ও এতো ইম্পোর্ট্যান্ট থাকে না বা ৭/১০ দিন যদি স্কুলে না যায় ওতোটা হ্যাম্পার করেনা। সেজন্য ৪-৬ হচ্ছে আইডিয়াল টাইম। তবে কোনো মেডিক্যাল গ্রাউন্ড যদি থাকে মনে করেন বারবার প্রস্রাবে ইনফেকশন হচ্ছে, ওর মাথায় একটু পুঁজ হয়েছে অথবা ঐটা আটকিয়ে গেছে যেটাকে ফাইমোসিস বলি অথবা একটা জিপার ইনজুরি হয়েছে এসব ক্ষেত্রে কিন্তু বয়স তখন কোনো ফ্যাক্টর না, যেকোনো বয়সেই এটা করা সম্ভব।”
আধুনিক ও নিরাপদ সুন্নতে খৎনার পদ্ধতি
Alisclamp Circumcision: এই পদ্ধতিতে একধরনের বিশেষ ক্ল্যাম্প ব্যবহার করে খৎনা করা হয় যার ফলে কোনো রক্তপাত হয় না, সেলাই এর প্রয়োজন হয় না এবং ৫-১০ মিনিটের মধ্যেই খৎনা সম্পন্ন হয়ে যায়। ক্ল্যাম্পটি ৫-৭ দিন পরে খুলে যায় কিংবা খুলে দেওয়া হয়।
Ring Circumcision: প্লাস্টিকের একটি রিং ব্যবহার করে এই খৎনা সম্পন্ন করা হয়। রক্তপাতের পরিমান কম হয় এবং সেলাই এর প্রয়োজন হয় না। রিং-টি ৭–১০ দিনের মধ্যে নিজে পড়ে যায়।
Laser Circumcision: উন্নত প্রযুক্তির লেজার দিয়ে চামড়া কাটা হয়। কম রক্তপাত ও ব্যাথা অনুভূত হয়। সাধারণত দাগ পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্ক ও বড় শিশুদের জন্য এটি একটি নিরাপদ মাধ্যম।
Cosmetic Circumcision: এই পদ্ধতিতে চামড়া অত্যন্ত নিখুঁতভাবে কাটা হয়। লেজার, স্ক্যালপেল বা electrocautery পদ্ধতিতে হতে পারে। রক্তপাত হয় না এবং সেলাই এর কোনো ঝামেলা নেই। এ পদ্ধতি সম্পন্ন করার জন্য অভিজ্ঞ সার্জনের প্রয়োজন হয়।
ইউটিআই এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে সুন্নতে খৎনার ভূমিকা
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের ক্ষেত্রে খতনা করালে লিঙ্গের ক্যান্সার প্রতিরোধ হয় ও যৌনবাহিত রোগের ঝুঁকি কমে। বাড়তি চামড়ার নিচে স্মেগমা নামক এক ধরনের সাদা পদার্থ জমে এবং এটিই পুরুষাঙ্গের ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, পুরুষের খতনা এইচআইভি বা এইডস প্রতিরোধে একটি কার্যকর ভূমিকা রাখে। আফ্রিকার যেসব দেশে খতনার হার বেশি, সেসব দেশে এইডসের হার তুলনামূলক কম।
খতনার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকজাতীয় (ব্যাকটেরিয়া) রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
অস্ট্রেলীয় মেডিকেল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. ব্রায়ান মরিস খতনা নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। তাতে উল্লেখ করা হয়, যেসব বালকের সারকামসিশন (খতনা) করা হয়নি, তাদের অপেক্ষাকৃত কিডনি, মূত্রথলি ও মূত্রনালির ইনফেকশন চার থেকে ১০ গুণ বেশি হয়।
তিনি বলেন, সারকামসিশনের (খতনা) মাধ্যমে অন্তত এক-চতুর্থাংশ মূত্রনালির ইনফেকশন হ্রাস করা সম্ভব।
ডা. রুবসন তাঁর গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, ১৯৩০ থেকে এ পর্যন্ত ৬০ হাজার মানুষ আমেরিকায় মূত্রনালির ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে, এর মধ্যে কেবল ১০ জন খতনাকৃত রয়েছে, বাকি সব খতনাবিহীন ব্যক্তি।
এ ব্যাপারে ইউরোলজি জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূত্রনালির প্রদাহ শিশুদের বেশি হয় এবং এতে কিডনির সমস্যা, জ্বর ও রক্তের ইনফেকশন পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি খতনা মরণব্যাধি এইডস ও যৌনরোগ প্রতিরোধে সহায়ক। সাধারণ অর্থে লিঙ্গের ক্যান্সার হলো অপরিচ্ছন্নতার ব্যাধি। পুরুষাঙ্গের শীর্ষে ঘা হয়ে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে একসময় ক্যান্সারে রূপ নেয়, এমন রোগীর ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, খতনা করানো পুরুষের চেয়ে খতনা না করানো পুরুষ এ ধরনের ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
খৎনার আগে ও পরে পিতামাতার করণীয়
কখন খতনা করাবেন
সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সকেই খতনা করানোর জন্য আদর্শ সময় বলে মনে করেন চিকিত্সকরা। তবে অন্য কোনো সমস্যা থাকলে কখনো কখনো এর আগেও খতনা করার প্রয়োজন হতে পারে।
এ জন্য শিশুর বয়স তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে যেকোনো সময় খতনা করাতে পারেন। শিশুর খতনা করানোর আগে দূরে কোথাও ভ্রমণ, শিশুর স্কুলের ছুটি, পারিবারিক উত্সব যেমন বিয়ে এসব বিষয় মাথায় রাখা ভালো।
শিশুকে মোটিভেট করুন
খতনা নিয়ে শিশুদের মনে অনেক ভয় কাজ করে। এটা খুবই স্বাভাবিক। এই ভয় দূর করতে হবে মা-বাবাকেই।
এ জন্য শিশুকে অভয় দিন। গল্প শোনান। আগে থেকেই শিশুকে তৈরি করুন। যেন খতনা নিয়ে অহেতুক কোনো ভয় শিশুমনে নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
হাজাম বা হাতুড়ে ডাক্তার নয়
এখনো গ্রামে হাজাম বা হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে সুন্নতে খৎনা করার প্রচলনই বেশি। তবে এই রেওয়াজ থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত। কেননাসুন্নতে খৎনা-পরবর্তী কোনো জটিলতা তৈরি হলে তা মোকাবেলা করার মতো দক্ষতা বা সুবিধা তাদের থাকে না। এখনো তাদের কেউ কেউ সনাতন বা পুরনো পদ্ধতিতেই সুন্নতে খৎনা করান। এতে শিশুদের অনেক অসুবিধা পোহাতে হয়। এ জন্য একজন দক্ষ সাজার্রি চিকিত্সকের কাছে শিশুর খতনা করানো বেশি নিরাপদ।
চিকিত্সকের সঙ্গে কথা বলুন
মন চাইল আর শিশুকে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে দিলেন। এমনটা করা যাবে না। শিশুকে নিয়ে আগে চিকিত্সকের সঙ্গে দেখা করুন। এতে চিকিত্সকের সঙ্গে শিশুর পূর্ব পরিচয় ঘটবে। চিকিত্সকও খতনা-পূর্ব কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিত্সা বা পরামর্শ দিতে পারবেন। আপনাদেরও একটি আস্থার জায়গা তৈরি হবে।
চিকিত্সককে সহায়তা দিন
শিশুরা অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে ভয় পেতে পারে এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য শুরুতেই শিশুকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয় না। শিশুকে আগে তৈরি করা হয়। তার সঙ্গে চিকিত্সকের কথা বলা, অজ্ঞান করা বা ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এ জন্য শিশুকে ওটিতে নেওয়ার আগ পর্যন্ত নিজেও অ্যাপ্রোন পরে অপারেশন দলের সদস্য হয়ে যান। শিশুকে বলুন আপনিও ডাক্তারের সঙ্গে থাকবেন। এরপর নির্দিষ্ট সময়ে বের হয়ে আসুন।
অপারেশন-পরবর্তী
আধুনিক অপারেশন পদ্ধদিতে খতনা-পরবর্তী কোনো জটিলতাই সাধারণত হয় না। সুন্নতে খৎনা করার কিছুক্ষণ পর থেকেই শিশুরা স্বাভাবিক চলাফেরা, খেলাধুলা করতে পারে। নেই কোনো খাবারদাবারের নিষেধাজ্ঞাও। সব কিছু খেতে পারবে সুন্নতে খৎনা করার পর। তবে শিশু যেন আঘাত না পায় সেদিকে কয়েক দিন সতর্ক থাকা জরুরি।
উপসংহার
সুন্নতে খৎনা একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং এটি নেওয়ার সময় সঠিক চিকিৎসক এবং নিরাপদ পরিবেশের গুরুত্ব অতীব জরুরি। আপনার সন্তানের সুস্থতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এই প্রক্রিয়া করা উচিত। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কমানোর জন্য, সবসময় এমন একটি স্থান বেছে নিন যেখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এবং প্রফেশনাল চিকিৎসকরা আপনাকে পূর্ণ সহায়তা দিতে পারেন।
আপনি যখন এই সিদ্ধান্ত নেবেন তখন মনে রাখবেন—সঠিক পদক্ষেপ এবং যত্নই আপনার সন্তানের জন্য সুরক্ষিত এবং সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে।